মো: মাসুম বিল্লাহ খান
উদ্যোক্তা উন্নয়ন বলতে বুঝায় একজন ব্যক্তিকে তার উদ্যোক্তা হবার উদ্দেশ্যকে শক্তিশালী করতে, পূরণ করতে এবং তার ভূমিকা কার্যকরভাবে পালনের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা এবং যোগ্যতা অর্জনে সহায়ক কর্মকান্ড।
উদ্যোক্তা উনয়ন কর্মসূচির মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলি হলো:
ক) প্রশিক্ষণের জন্য উদ্যোক্তা সনাক্তকরণ ও নির্বাচন;
খ) প্রশিক্ষণার্থীর উদ্যোক্তা সক্ষমতা উন্নয়ন;
গ) প্রশিক্ষণার্থীদের মৌলিক ব্যবস্থাপনাগত জ্ঞান, দক্ষতা ও কৌশল রপ্ত করা;
ঘ) প্রতিটি সম্ভাব্য উদ্যোক্তার জন্য একটি কার্যকর শিল্প প্রকল্প নিশ্চিত করা;
ঙ) উদ্যোক্তার জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক, অবকাঠামোগত ও আনুষঙ্গিক সহায়তা প্রদান করা।
দ্রুত শিল্পোনয়নের জন্য উদ্যোক্তাদের সহযোগিতা বৃদ্ধি করা, গ্রামীণ ও অনগ্রসর অঞ্চলগুলিকে শিল্পায়িত করা, শিক্ষিত যুবক-যুবতীদের জন্য লাভজনক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, উদ্যোক্তার উৎসে বৈচিত্র আনা এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের মধ্যে ব্যবস্থাপনাগত দক্ষতা বিকাশের মাধ্যমে ক্ষুদ্র শিল্পের কর্মক্ষমতা উন্নত করাই উদ্যোক্তা উন্নয়ন কর্মসুচীর উদ্দেশ্য।
উদ্যোক্তাদের মধ্যে ব্যবস্থাপনাগত দক্ষতা বিকাশের মাধ্যমে ক্ষুদ্র শিল্পের কর্মক্ষমতা উন্নত করাই উদ্যোক্তা উন্নয়ন কর্মসুচীর উদ্দেশ্য।
ক) প্রাক-প্রশিক্ষণ পর্যায়: প্রাক-প্রশিক্ষণ পর্যায় প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম চালু করার জন্য সমস্ত কর্মকান্ড বা প্রস্তুতি নিতে হবে।
খ) প্রশিক্ষণ পর্যায়: প্রশিক্ষণ কর্মসূচীর প্রাথমিক উদ্দেশ্য হল সম্ভাব্য উদ্যোক্তাদের মধ্যে অনুপ্রেরণা এবং দক্ষতার বিকাশ ঘটানো। প্রশিক্ষণার্থীদের এ পর্যায়ে তাত্বিক ও ব্যবহারিক উভয় প্রকার জ্ঞান ও দক্ষতা প্রদানের ব্যবস্থা নেয়া হয়।
গ) ফলো-আপ পর্যায়: ফলো-আপ পর্যায়কে প্রশিক্ষণ-পরবর্তী পর্যায় হিসাবে অভিহিত করা হয় যার চুড়ান্ত লক্ষ্য হল দক্ষ উদ্যোক্তা তৈরি করা।
এ কর্মসুচী আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্ব বহন করে, যেমন:
১. কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়
২. এর মাধ্যমে মূলধন গঠন সহজ হয়
৩. ভারসাম্যপূর্ণ আঞ্চলিক উন্নয়ন হয়
৪. স্থানীয় সম্পদের ব্যবহার ও মাথাপিছু আয় বাড়ানো যায়
৫. জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন সম্ভব হয়
৬. অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জিত হয়
৭. শিল্প বস্তি প্রতিরোধ করা যায়
৮. সামাজিক উত্তেজনা কমানো যায় ও
৯. সামগ্রিক জাতীয় উন্নয়ন সহজতর হয়।
উদ্যোক্তা উন্নয়ন (এন্টারপেনারশিপ ডেভেলপমেন্ট) এর মূল কথা হলো “উদ্যোগ বা এন্টারপ্রাইজ”। উদ্যোগ বা এন্টারপ্রাইজ হলো এমন একটি প্রক্রিয়ার যার মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের কাঁচামাল ব্যবহার করে পণ্য বা সেবা উৎপাদন করা যায় অথবা পণ্য বা সেবার মূল্য সংযোজন/মান উন্নয়ন করা যায় । উৎপাদিত বা মান উন্নয়নকৃত পন্য বা সেবা বিক্রয় করে কিছু অর্থ উপার্জন করা হয়।
উদ্যোগের (এন্টারপ্রাইজের) বৈশিষ্ট্য হলো-
ব্যবসা পরিচালনায় উদ্যোক্তাদের কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় যা নারীদের জন্য আরও প্রকট হয়ে দেখা দেয় যেমন-
ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমস্ ইন্টারন্যাশনাল ম্যাকবার নামক একটি দল বিশ্বব্যাপী এক ব্যাপক গবেষণায় প্রমাণ করেছেন যে, মোট দশটি প্রধান ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য কোন ব্যক্তিকে সফল উদ্যোক্তা হতে সাহায্য করে। যেমন:
সুযোগ সন্ধান : ব্যবসা সংক্রান্ত নতুন নতুন সুযোগ সন্ধান একজস সফল উদ্যোক্তার বৈশিষ্ট। আর্থিক সংস্থান, যন্ত্রপাতি, জমি, কর্মস্থান বা অন্যান্য সাহায্য লাভের জন্য লক্ষ্যণীয় সুযোগগুলো হস্তগত করতে একজন উদ্যোক্তা সচেষ্ট হবেন।
অধ্যবসায় : কোন বাধাকে দ‚র করতে অবিরাম বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করবেন একজন উদ্যোক্তা। কোন কাজ সম্পন্ন করার জন্য ব্যক্তিগত উৎসর্গের মতো বিশেষ প্রচেষ্টা চালাতে হবে। প্রাথমিক ব্যর্থতা সত্তে¡ও নিজের সিদ্ধান্তের প্রতি অটল থাকা প্রয়োজন।
কাজের প্রতিশ্রুতি রক্ষা : গ্রাহকদের জন্য কাজ সম্পন্ন করতে গিয়ে উদ্ভুত সমস্যাবলীর দায়-দায়িত্ব নিতে হবে। শ্রমিকদের সাথে কাজে লেগে থাকা এবং তাদের মাধ্যমে কাজগুলো করিয়ে নিতে সচেষ্ট থাকতে হবে , যাতে গ্রাহকগণ সর্বদা সন্তুষ্ট থাকেন।
গুণগত মান ও দক্ষতার চাহিদা : এমনভাবে কাজ করতে হবে যেন তা প্রচলিত মানকে অতিক্রম করতে পারে বা অতীত কর্মসম‚হের চেয়ে উন্নততর মানের হয়। অধিকতর ভালভাবে, দ্রুত ও তুলনাম‚লক সস্তায় সেবা দিতে সচেষ্ট থাকা প্রয়োজন।
ঝুঁকি গ্রহণ করার মানসিকতা: উদ্যোক্তার নিজের মত অনুযায়ী সহনীয় ঝুঁকি গ্রহণ করা ও সহনীয় ঝুঁকি সম্পন্ন পরিস্থিতিতে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।
লক্ষ্য নির্ধারণ: সুনির্দিষ্ট ও স্পষ্ট স্বল্পমেয়াদি উদ্দেশ্য নিধারণ করা ও পরিষ্কার দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য নির্ধারণ করা উদ্যোক্তার একটি প্রধানতম বৈশিষ্ট্য।
সুশৃঙ্খল পরিকল্পনা ও পরিবীক্ষণ : লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য যুক্তিসঙ্গত পদক্ষেপসহ পরিকল্পনা তৈরি করা ও অনুসরণ করা , বিকল্প পদক্ষেপগুলো ম‚ল্যায়ন করে লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রয়োজনে বিকল্প পদক্ষেপসম‚হ গ্রহণ করা উদ্যোক্তার বৈশিষ্ট্যসমূহের মধ্যে অন্যতম। বিকল্প কৌশল গ্রহণের পূর্বে অগ্রগতি পরিবীক্ষণ করতে হবে।
তথ্য অনুসন্ধান : ব্যক্তিগতভাবে গ্রাহক, সরবরাহকারী ও প্রতিযোগীদের সম্পর্কে তথ্য অনুসন্ধান করবেন। তথ্য সংগ্রহের জন্য প্রয়োজনীয় যোগাযোগ ও তথ্য সংগ্রহ করতে হবে।
প্রণোদনা /উদ্বুদ্ধকরণ ও/নেটওয়ার্কিং এর মাধ্যমে যাগাযোগ এর মাধ্যমে অন্যদের প্ররোচিত করা বা প্রভাবিতকরার সুচিন্তিত কৌশল ব্যবহার করতে হবে। নিজের উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য ব্যবসায়িক ও ব্যক্তিগত যোগাযোগ রক্ষা দরকার।
আত্মবিশ্বাস : নিজস্ব নৈপ‚ণ্য বা দক্ষতার উপর এবং নিজের দৃঢ় বিশ্বাস থাকতে হবে। একটা জটিল কাজ সম্পাদন করতে নিজের সাহায্যের উপর অবিচল আস্থা প্রকাশ করবেন অথবা একটা চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করুন।
১. অভিজ্ঞতা/দক্ষতা : ব্যবসা শুরু করার আগে আমাদের নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর যাচাই করে নিতে হবে। ব্যবসাটি করার জন্য আমার জ্ঞান বা পূর্বঅভিজ্ঞতা আছে কী না,দক্ষতা আছে কী না, উৎপাদন কৌশল জানা আছে কী না, এ ব্যবসার জন্য যন্ত্রপাতি বা উপকরণ কী কী লাগবে? যদি আমাদের এ ব্যাপারে জ্ঞান ও দক্ষতা না থাকে তবে তা শুরুর পূর্বে ভালভাবে শিখে নিতে হবে।
২. পণ্যের চাহিদা: আমরা যে ব্যবসা করতে যাচ্ছি সেই পণ্যের চাহিদা ঐ এলাকায় আছে কী না বা আমার ব্যবসাটি চলবে কী না। এক্ষেত্রে নীচের প্রশ্নগুলো আমাদের চিন্তা করা প্রয়োজন -পণ্য বা সেবা কে খরিদ/ক্রয় করবে, সেখানে কি পর্যাপ্ত ক্রেতা আছে, পণ্য কোথায় বিক্রি করবো, বৎসরের সব সময়েই কি পণ্য বিক্রি করা যাবে ও মৌসুমভেদে পণ্যের চাহিদা কি কম/বেশী হতে পারে।
৩. লাভজনক কিনা: ব্যবসাটি শুরুর আগে চিন্তা করে দেখতে হবে ব্যবসাটি লাভজনক হবে কী না । ব্যবসায় লাভ না হলে পুঁজি নষ্ট হবে। সংসার ভালভাবে চলবে না। তাই ব্যবসা শুরুর আগে নিচের বিষয়গুলো চিন্তা করতে হবে : কী পরিমাণ জিনিস বিক্রি হবে? প্রতি সপ্তাহে অথবা মাসে কত টাকার বিক্রি করতে পারবো, কত টাকার কাঁচামাল লাগবে, সব খরচ বাদ দিয়ে যে আয় হবে তা দিয়ে সংসার চলবে কী না ও মাসে মাসে সঞ্চয় করতে পারব কী না।
৪. ব্যবসা পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় পুঁজি দেখতে হবে ব্যবসাটি পরিচালনার জন্য যে পরিমাণ পুঁজির দরকার সেই পরিমাণ পুঁজি বা টাকা আছে কী না। এ ক্ষেত্রে চিন্তা করতে হবে ব্যবসাটি করতে মোট কত টাকা পুঁজি লাগবে,এর মধ্যে আমার নিজস্ব কত, বাকি পুঁজি কোথায় পাওয়া যাবে, কত টাকা বিনা সুদে ধার করা যাবে, কত টাকা ঋণ নিতে হবে ও পুঁজি সংগ্রহের জন্য কত খরচ হবে বা কত সুদ দিতে হবে।
৫. ঝুঁকি হচ্ছে নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ভবিষ্যতের এমন কিছু বিষয় যা ব্যবসার জন্য বাধা বা সমস্যা হিসেবে কাজ করে। ফলে ব্যবসার সাধারণ গতি ব্যহত হয়। তাই ব্যবসার শুরু করার আগে নিচের বিষয়গুলো চিন্তা করতে হবে –
আমার ব্যবসার ভবিষ্যতে সম্ভাব্য কী কী ঝুঁকি আছে, তা আমরা ভালভাবে জানি কী না?
এই সকল ঝুঁকি মোকাবেলায় আমাদের করণীয় কী বা কীভাবে এই সকল ঝুঁকি মোকাবেলা করবো এবং ঝুঁকি মোকাবেলায় আমাদের প্রস্তুতি আছে কী না।
বিশ্বায়নের যুগে বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নবনব উদ্যোগ গ্রহণ, নবতর ধারনা ও কলাকৌশলে সমৃদ্ধ যুব উদ্যেক্তার কোন বিকল্প নেই যা জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখবে বলে আমরা আশাবাদী।
মো: মাসুম বিল্লাহ খান, কান্ট্রি রিপ্রেন্জেটিভ, ডাকভাঙ্গা বাংলাদেশ